নামাজ, সমাজ ও রাষ্ট্র

আলোচনার বিষয হল নামাজ, সমাজ ও রাষ্ট্র৷ এই তিনটি বিষয় মিলে একটি উন্নত সমাজ গঠিত হতে পারে৷


      ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ ঈমানদার মুসলমানরা প্রতিদিন 5 বার নামাজ পাঠ করে৷ ঐ নামাজ বাড়ীতে একা একা পাঠ করার তুলনায় মসজিদে পুরুষ ও মহিলারা ঐক্যবদ্ধভাবে ( জামাতবদ্ধভাবে) পাঠ করা অধিক পুণ্যের কাজ হিসাবে বিবেচিত হয়৷ এটাই নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা৷ প্রতিদিন 5 বার মসজিদে মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সমস্ত ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধার.ণ-অসাধারণ মুসলমানদেরকে এক সারিতে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ এতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সমাজে বড়-ছোট, উঁচু-নিচু, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য বা জাতপাতের সামান্যতমও দুর্গন্ধ নেই৷

       এই মাত্র সেদিন 1789 সালে ফরাশী বিপ্লবে উচ্চারিত হল "Liberty, Equality & Fraternity, (সাম্য-স্বাধীনতা-সৌভ্রাতৃত্ব৷)" বিগত কয়েক শতাব্দি ধরে ইউরোপ-আমেরিকার দার্শনিকরা ন্যায়, সাম্য, অধিকার, নারীর অধিকার, ক্রীতদাসদের অধিকার, মানবাধিকার প্রভৃতি উত্থাপন করে আসছিলেন৷ যেটা ইসলাম 1500 বছর পূর্বে শুধু মৌখিক ঘোষণাই নয় বরং পূর্ণভাবে কার্যকর করে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজে৷ এই সামাজিক সাম্যের বহিঃর্প্রকাশ হল দিনে 5 বার এক লাইনে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের জামাতবদ্ধভাবে নামাজ পালন করা৷ এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ধর্মের মূল স্পিরিট কোরআন ও হাদিসে সামান্যতম কোন ধরণের ভেদাভেদের সমর্থন নেই৷ অতএব ইসলামে নামাজই হল সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ৷

       এর পর দ্বিতীয় হল সমাজ৷ একটা মানুষ সমাজের মধ্যে, সমাজের সহযোগিতায়, সমাজের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে এবং জীবন যাপন করে৷ সে, তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী এবং তার চতুস্পার্শের লোকজনকে দেখে সব কিছুকে আত্মস্থ করে৷ ওটাই হল তার কাছে জীবন্ত সমাজ৷ প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তার পারিপার্শিক অবস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে থাকে৷ সমাজের অধিকাংশ মানুষ যেমন হয় সেও ঠিক তেমনটি হওয়ার চেষ্টা করে৷ ব্যতিক্রম সর্বদা ব্যতিক্রমই৷ নামাজ পাঠকারী লোকজন ইসলামের এই ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে যদি সমাজে ন্যায় ও সাম্যের প্রভাবকে কার্যকরী করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে এবং তাকে বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেয় তাহলে সমাজ ক্রমবর্ধমান গতিতে উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছে যাবে৷ এতে কোন সন্দেহ নেই৷

        রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে এতটুকু বলা যায়— যে সমাজে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান, তারা যদি নামাজ পাঠে অভ্যস্ত হয় এবং শিক্ষিত, সমাজ সচেতন, ধৈর্যশীল, ঈমানদার, জ্ঞানী, চেতনাসম্পন্ন, দূরদর্শী, সামাজিক, খোদাভীরু, কোরআন-হাদীসের আলোকে আলোকিত হয়ে , নীতি-আদর্শে চরিত্রবান ও আস্থাভাজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়৷ সেই সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাস, ভারতের সমাজব্যস্থা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন-কানুন, ধর্ম-সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-কূটনীতি-দেশের সংবিধান প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করে দেশ ও দেশবাসীর নিকট বিশ্বস্ততা লাভে সাফল্য অর্জন করে এবং শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং গোটা দেশবাসী তথা মানব সমাজের অসহায় ও পরনির্ভরশীল মানুষের কল্যাণের জন্য আন্দোলন শুরু করে তাহলে হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান-শিখ-বৌদ্ধ, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ সকল গোষ্ঠীর সমর্থন ও সহযোগিতা লাভে সক্ষম হবে৷ আমার ধারণা, ভারতের মুসলমানরা যদি এরকম কোন মৌলিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সমাজ উন্নয়ণের কাজে অগ্রসর হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে নামাজী মুসলমানদের দ্বারা এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হবে৷ এর দ্বারা ভারতের মুসলমানরা উপকৃত হবে এবং অমুসলিমরাও সন্তুষ্ট হবে, সর্বোপরি ভারত ও ভারতবাসীর কল্যাণ হবে৷

       দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয় যে, বর্তমান ভারতের মুসলমানরা এই ভাবনা-চিন্তা থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে৷ তারা নিজেদের সংশোধন করে, নিজ সমাজকে প্রস্তত করার দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত নয়৷ অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীদের সঙ্গে গঠনমূলক প্রতিযোগিতা করতেও প্রস্তুত নয়৷ বরং অপরের প্রতি দোষারোপ করে নিজেরদেরকে আরো হাস্যাস্পদ করে চলেছে৷ নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব, ধর্মীয় দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং নৈতিক দায়িত্ব ও সর্বোপরি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে কেবলমাত্র সমালোচনা করেই কোন জাতি, গোষ্ঠীর উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং এই পৃথিবীতে টিকে থাকাও সম্ভব নয়৷

      আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে— মুসলমান সমাজে যারা প্রতিদিন 5 বার নিষ্ঠার সঙ্গে নামাজ পাঠ করে তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ, রাষ্ট, অর্থনীতি, রাজনীতি, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন নয়৷ অনুরূপভাবে মুসলমান সমাজে যারা এই সমস্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ তারা নামাজ ও মসজিদ থেকে বহুদূরে অবস্থান করে৷ যেদিন নামাজীরা উচ্চশিক্ষিত হবে এবং উচ্চশিক্ষিতরাও নামাজ পাঠ করবে সেদিনই নামাজ, সমাজ ও রাষ্ট্র ভিত্তিক পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে, অন্যথায় নয়৷





 width=