সংবিধান রচনা করতে গিয়ে অসহনীয় পরিশ্রমে প্রান গিয়েছে ডঃ আম্বেদকরের। তাঁর সেই ঋনের কথা ভারতবাসী কী কখনো ভাবে ?

ভারতের সংবিধান রচনার ইতিহাস বড়ো করুন, বড়ো বেদনার ইতিহাস --- যা আজও মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেল।এই সংবিধান রচনা করতে গিয়ে অমানসিক পরিশ্রমে বাবা সাহেব ডঃ B.R. আম্বেদকরের অকালে প্রান হারাতে হয়েছে --- শুধু ভারতবাসীর কথা ভেবে, তাঁর চিরবঞ্চিত-অবহেলিত জাতি ও সমাজের কথা ভেবে। কি সেই ইতিহাস ----?

                   স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য কংগ্রেসের তিন সদস্যের একটি দল " সংবিধান বিশেষজ্ঞ " খুঁজতে বিদেশে পাড়ি দিলেন।আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মান, কানাডা ঘুরে বিফল হয়ে অবশেষে তারা বিলেতে গেলেন।সেখানে গিয়ে তৎকালিন অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান বিশেষজ্ঞ জেমস মার্ক এর কাছ থেকে জানতে পারেন --" আপনাদের দেশেই তো রয়েছেন পন্ডিতপ্রবর আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ডঃ আম্বেদকর।ভারতের মতো বৈচিত্রময় দেশের সংবিধান রচনা করা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব।তিনি সংবিধান রচনার জীবন্ত মূর্তি " ( জেমস মার্কের The Constitution in India প্রবন্ধ থেকে সংকলিত)।কিন্তু অস্পৃশ্য মুচির ছেলে লিখবেন ভারতের সংবিধান ?-- এটা তারা প্রথমে মেনে নিতে পারেন নি।অবশেষে তাঁরা নিরুপায় হয়ে সংবিধান রচনার প্রধান দায়-দায়িত্ব ডঃ আম্বেদকরের উপর সমর্পণ করেন।ভাবা যায় ! ডঃ আম্বেদকর তখন কংগ্রেস এবং বর্নহিন্দুদের বিরুদ্ধে সমালোচনায় মুখর, অথচ তাঁকে দিয়েই লিখতে হবে ভারতের সংবিধান ? যে কংগ্রেসী সদস্যবৃন্দ ডঃ আম্বেদকরকে একদা গনপরিষদে প্রবেশের অধিকার পর্যন্ত দিতে চায়নি, সমস্ত ভারতব্যাপী কংগ্রেসীরা তাঁর প্রচন্ডতম বিরোধীতা করেছেন, আজ তাঁরাই কত বিপদে পড়লে ডঃ আম্বেদকরকে দিয়ে সংবিধান রচনা করাতে বাধ্য হয় ?  এরপর ২৯ শে আগস্ট ১৯৪৭ সালে গনপরিষদের অধিবেশনে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ৭ সদস্যের " খসড়া কমিটি " তৈরি করা হয়। সর্ব সম্মতিক্রমে এই খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ডঃ আম্বেদকর।কমিটিতে ৭ জনের নাম থাকলেও ডঃ আম্বেদকরকে সম্পূর্ণ সংবিধানটি প্রায় নিজেরই লিখতে হয়। 


গনপরিষদের বৈঠকে টি. টি. কৃষ্ণমাচারীর বক্তৃতায় সেই কারনটা পরিস্কার বোঝা যায়।মিঃ কৃষ্ণমাচারী সংবিধান রচনা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।তিনি গনপরিষদে বক্তৃতায় বলেন --" গনপরিষদের সদস্যবৃন্দ অবগত আছেন, আপনারা সংবিধান রচনা কমিটিতে ৭ জনকে মনোনীত করেছিলেন। একজন পদত্যাগ করায় তাঁর স্থলে নতুন আমাকে নেওয়া হয়েছে।একজন সদস্য মারা গিয়েছেন, একজন আমেরিকায় চলে গিয়েছেন, দুজন অসুস্থতার কারনে দিল্লীর বাইরে, কাজ করতে পারে না। একজন সদস্য সরকারী কাজে ব্যস্ত থাকায় সময় দিতে পারেননি।এই পাঁচ জনের জায়গায় নতুন কাউকে নেওয়া হয়নি।সুতরাং অনিবার্য কারনে সমস্ত সংবিধান লেখার দায়িত্ব একাই ডঃ আম্বেদকরকেই বহন করতে হয়েছিল এবং সে কাজ তিনি এতো সুন্দর ভাবে ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করেছেন যে আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ "।গনপরিষদের চেয়ারম্যান তথা স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন --" ডঃ আম্বেদকর তাঁর শরীরের দিকে না তাকিয়েও এই সংবিধান তৈরির জন্য একটা অসম্ভব মানসিক শ্রম দিয়েছেন।আমরা সংবিধান তৈরির জন্য যোগ্যতম ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিলাম এবং তিনি এতো অল্প সময়ের মধ্যে এমন একটা সুন্দর সংবিধান আমাদের দিতে পেরেছেন, যার সমকক্ষ আর কোথাও নেই ? " বিশ্বের বৃহত্তর লিখিত এই সংবিধান রচনা করতে সর্বমোট সময় লাগে ২ বছর ১১ মাস ১৮ দিন। এই সংবিধানে মোট ২৪ টি অংশে ৪৪৮ টি ধারা, ১২ টি তফসিল রয়েছে।

                 ডঃ আম্বেদকর যখন সংবিধান রচনার দায়িত্ব কাধে তুলে নেন, তখন তাঁর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ।ডায়বেটিস, ব্লাডপ্রেশারে   ভুগছেন।অনাহারে ( টিবিরোগে) পুত্র বিয়োগ, বিনা চিকিৎসায় স্ত্রী বিয়োগ ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক চরম অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।এমতাবস্থায় রাতের পর রাত জেগে সংবিধান রচনা করতে গিয়ে তাঁর শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়ে।তবুও তিনি বিরামহীন লিখে চলেছেন ভারতের সংবিধান।বাবাসাহেবের জীবনের শেষ ১৭ বছরের অপ্ত-সহায়ক, ব্যক্তিগত সচিব, ছায়া সঙ্গী ও নিত্য সহচর শ্রী নানক চাঁদ রত্তু ডঃ আম্বেদকরকে বার বার নিষেধ করেছেন এতো পরিশ্রম না করতে।একদিন গভীর রাত পর্যন্ত একাগ্র চিত্তে সংবিধান লিখে চলেছেন বাবাসাহেব। তখন রত্তু গিয়ে তাঁকে বিশ্রামের জন্য বার বার অনুরোধ করে বলেন --- " স্যার, আপনি ইতিপূর্বে একান্তই অসুস্থ রয়েছেন, তার উপর শরীরের প্রতি এমন নির্যাতন হলে অনতিবিলম্বে মৃত্যু মুখে পতিত হবেন (" Last few years of Dr Ambedkar "-- by Sri Nanakchand Rattu)। বাবা সাহেবের চোখে জল আসে, আবেগে তাঁর স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।তিনি অত্যন্ত ব্যকুল হয়ে বলেন ---" রত্তু , এজীবন তো একদিন না একদিন শেষ হয়ে যাবেই।

        কিন্তু অতিকষ্টে সংবিধান রচনার যে দায়িত্ব আমি পেয়েছি, তা যদি শেষ করে যেতে না পারি তাহলে বর্ণহিন্দুরা তাদের সুবিধা মতো সংবিধান লিখে তাঁদের স্বার্থকেই সংবিধানের মাধ্যমে ভারতে প্রতিষ্ঠা করবেন, যেমন ভাবে অতীতে ব্রাহ্মনেরা শাস্ত্র গ্রন্থ রচনা করে দেশের সর্বত্রই ব্রাহ্মনের স্বার্থকেই বজায় রেখেছেন।তাই আমার চির বঞ্চিত, হতভাগ্য মানুষ গুলি যারা হাজার হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মন্যবাদী শোষন-নির্যাতনে ক্রীতদাসে পরিনত হয়েছে, ভারতের ভাগ্যাকাশে তাদের মুক্তিলাভ আর সম্ভব হবে না। আমি চোখ বন্ধ করলেই তাদের সেই আর্তনাদ শুনতে পাই - - - আমাদের বাঁচাও, আমাদের শৃঙ্খল মুক্ত করো" ( ঐ - Last few - -)।পাশে সজল চোখে রত্তু দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুদিন পরেই ধীরে ধীরে বাবাসাহেবের শরীর একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে, যা আর পূরন করা সম্ভব হয়নি। 

                ডঃ আম্বেদকর খসড়া সংবিধান রচনা করে গনপরিষদের ২০৭ জন সদস্যের সামনে ৪-ঠা নভেম্বর ১৯৪৮ সালে গনপরিষদের সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের হাতে তুলে দেন এবং এরপর গনপরিষদের ভিতর ২০৭ জন সদস্যের মধ্যে সংবিধান নিয়ে চলে "কাটা-চেরা, বাছাই"।গনপরিষদের ২০৭ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন উচ্চবর্নীয়, জমিদার, বুর্জোয়া, শিল্পপতি, একদল ধনী কংগ্রেসী এবং একদল গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী।এরা চেয়েছিলেন " মনুসংহিতার আদলে একটি সংবিধান রচিত হোক "।আর ভারতের দরিদ্র শূদ্রশ্রেনীর প্রতিবাদী প্রতিনিধি ছিলেন একমাত্র ডঃ আম্বেদকর।ফলে এই উচ্চবর্ণের ধনীক শ্রেনী সেদিন সংবিধানের আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে তাদের সুবিধা চিরকাল বজায় রাখার জন্য সংবিধান থেকে একের পর এক " শূদ্রকল্যান মূলক " ধারা গুলি বা দিয়ে নিজেদের মতো করে সংশোধন করে নেয়।ডঃ আম্বেদকর সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও সেদিন কিছু করতে পারেনি, কারন তিনি একা।তাঁর সঙ্গে গলা মিলানোর আর কেউ নেই।তাই ডঃ আম্বেদকর চরম দুঃখ ও ক্ষোভ নিয়ে বলেন ---" গনপরিষদে বসে আমার রচিত সংবিধানের উপর একের পর এক ছুরিকাঘাত করে চলেছে।এই ছুরিকাঘাত যেন আমার হৃদয়ের উপর বর্শিত হচ্ছে। বর্ণবাদীরা নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা বজায় রাখার জন্য সংবিধানের সমস্ত রসটুকু শোষন করে নিয়ে বঞ্চিত- অস্পৃশ্য সমাজের জন্য রেখেছে শুধু ছিবড়ে " (আম্বেদকর রচনাবলী,ডঃ আম্বেদকর প্রকাশনী, খন্ড-৮)।তিনি আরো দুঃখ করে বলেন --" সংবিধানকে দেশের গনদেবতার মন্দির হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু গনদেবতা আসীন হওয়ার পূর্বেই  মন্দিরের বেদীটি শয়তানেরা দখল করে নিয়েছে।আজ আমাদের প্রধান কাজ হবে এই সংবিধানকে অবিলম্বে ভস্মীভূত করা" ( ঐ)।একবার ভাবুন দেখি, যে সংবিধান রচনা করতে গিয়ে নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখেছেন, সেই মানুষটিই সংবিধান পুড়িয়ে ফেলার কথা বলেছেন।তাই ডঃআম্বেদকর একটি অপূর্ন স্বপ্ন রেখে গেছেন ---" আমার সংবিধানের মূল কপিটি রেখে গেলাম।যদি কোনদিন আমার মানুষেরা এদেশের শাসক হয়, সেদিন যেন তারা এই সংবিধানকে চালু করতে বদ্ধ পরিকর হয় "(ডঃ আম্বেদকর রচনাবলী, কল্যান মন্ত্রক দ্বারা প্রকাশিত,খন্ড- ১৫)।      

                       এসব ঘটনার পরেও বাবাসাহেব বলেছেন---" এতদসত্ত্বেও সংবিধানে যতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি,পরবর্তী রাজনৈতিক শাসকরা যদি তার সুষ্ঠ প্রয়োগ করে তবে আমার চির বঞ্চিত মানুষ গুলির ধীরে ধীরে মুক্তি ঘটবে" ( ঐ)।সংবিধানের ভালোমন্দ বিচার হয় রাজনৈতিক শাসক দলগুলি কিভাবে সংবিধানকে ব্যবহার করবে তার উপর। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, ১৯৫০ সালের ২৬- শে জানুয়ারী দেশের সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যাদের হাতে সংবিধান পরিচালনার দায়িত্বভার রয়ে গেছে, তাঁরা হলেন সেই মনুবাদী- ব্রাহ্মন্যবাদী-উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। ফলে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও " এদেশের ৪৩% মানুষ অর্ধাহারে থাকে, ২২% মানুষ প্রায়-অনাহারে থাকে, ৬৮% মানুষের গড় আয় ২০ টাকার কম, ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত দেশের ৮৮% মানুষ, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত ৯০.১% শিক্ষার্থী" ( ৩/৮/২০১৫ সালের কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যান মন্ত্রকের একটি রিপোর্ট)।  তাই চোর, ডাকাত, খুনি, লম্পট,প্রতারক,শোষকদের হাতে পড়ে সংবিধানের অমর্যাদা হচ্ছে বার বার। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় " বহুজন রাজ কায়েম " করা।অন্যথায় দলিত-শোষিত-বঞ্চিত-মূলনিবাসী-বহুজন সমাজের মুক্তি ঘটা সম্ভব নয়--- মুক্তি ঘটতে পারেনা কখনো।


                  সিদ্ধা বুক সেন্টার 

          দুরামারি :  : জলপাইগুড়ি





 width=