হজরত মুহাম্মদ ﷺ এর শিক্ষা ও অবদান

   হজরত মুহাম্মদ (সঃ) 570 খৃষ্টাব্দে আরব দেশের মক্কা শহরে  জন্মগ্রহণ করেন ৷ তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লা আর মাতার নাম আমিনা ৷ তিনি বড় হয়ে দেখলেন যে, সমাজের মধ্যে নানা রকমের সমস্যা বিরাজ করছে ৷ মানুষ আছে কিন্তু মনুষ্যত্ব বর্জিত ৷ নারী আছে কিন্তু সতীত্ব বর্জিত ৷ সমাজে নানা রকম সামাজিক ব্যধি, অসংখ্য কুসংস্কার ও কুপ্রথা প্রচলিত ৷ যেমন— মদ্যপান, জুয়াখেলা, চুরী, ডাকাতী, রাহাজানী, বহুবিবাহ নয় ডজন-ডজন বিবাহ, অন্যায়, অপরাধ,  ক্রীতদাস প্রথা, গোত্র-বর্ণ , বৈষম্য, বিভেদ, শিশুকন্যা হত্যা, রক্তপাত-খুন-হত্যা, অকারণে যুদ্ধ, নারীর বহূগামীতা, মূর্তীপূজা প্রভৃতি ৷ এ ছাড়া আরো বহু রকমের অসামাজিক  কাজ বা রসম-রেওয়াজের প্রচলন ছিল ৷ মানুষের জন্য সব থেকে বড় বিপদ ছিল কথায়-কথায় খুন-জখম-হত্যা ৷ মানুষ একা একা নির্বিঘ্নে বা নিশ্চিন্তে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারত না ৷ সামান্য কারণে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ লেগে যেত এবং বহুদিন, বহুমাস বা বহু বছর ধরে চলতে থাকত ৷ তারা মদ্যপান করতে আর রক্তপাতে ভীষন আগ্রহী ছিল ৷ এমন এক অসভ্যতাপূর্ণ সমাজে হজরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্ম হল৷


   তিনি অত্যন্ত দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়ে অল্প বয়সেই কর্মজগতে প্রবেশ করলেন এবং সমাজের সামগ্রিক অবস্থাপর্যালোচনা করলেন ৷ তিনি 17 বছর বয়সেই হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংগঠনে যুক্ত হয়ে যুবকদেরকে সঙ্গে নিয়ে নানা রকমের অন্যায় কাজ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালালেন ৷ 25 বছর বয়সে খাদীজার সঙ্গে বিবাহ হল ৷  40 বছর বয়সে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে নবী হিসাবে ঘোষণা করা হল ৷ নবী বা রসুল হয়েই তিনি পুনরায় মানব সমাজকে সংস্কার এবং  সংশোধন করার কাজে নিষ্ঠাসহকারে আত্মনিয়োগ করলেন ৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নিকট জিব্রাইল (আঃ) ফেরেশতার মাধ্যমে পবিত্র কোরআন নিয়মিতভাবে অবতীর্ণ হতে লাগল ৷ তিনি প্রথমে নিজে কোরআন পড়ে অর্থ বুঝে সেইমত চলতে লাগলেন তারপর মানুষদের নিকট কোরআনের বাণীগুলো লোকদেরকে পড়ে পড়ে শুনাতে লাগলেন ৷ তাদের মাতৃভাষা ছিল আরবী সেই জন্য পবিত্র কোরআনের ও ভাষা ছিল আরবী এতে তাদের বোঝার ক্ষেত্রে সুবিধা ছিল ৷ ফলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নবীর আহ্বানে মক্কার  লোকেরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ল ৷ মক্কার বিভিন্ন পরিবার বা বিভিন্ন গোত্র থেকে  বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ নারী-পুরুষ মিলিতভাবে ইসলাম গ্রহণ করল৷

    মাত্র 13 বছরের আন্দোলনে নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর আহ্বানে যারা যুক্ত হল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ছিলেন— গরীব, শ্রমিক, ক্রীতদাস, মহিলাসহ সমাজের দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত, পরনির্ভরশীল, দুর্বল ও মেহনতি মানুষের দল ৷ ধীরে ধীরে নবীর আন্দোলন গতিশীল হতে থাকল ফলে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হল ৷ শাসক গোষ্ঠী ষ্পষ্টভাবে অনুভব করল যে, যেভাবে নবীর আন্দোলন ক্রমশঃ শক্তিশালী হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে নবীকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে ৷ নবী (সঃ) মক্কায় ছিলেন শক্তিহীন, দুর্বল, অসচ্ছল, শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ৷ প্রায়শঃ নবীর সাহাবা অর্থাৎ নবীর সঙ্গীদের উপর অকারণে জুলুম-অত্যাচার করা হত ৷ শেষ পর্যন্ত মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ নবী মুহাম্মদ (সঃ) কে তাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ধর্মের এবং বাপ-দাদাদের বিরোধী বলে ঘোষণা দিয়ে তাঁকে হত্যা করার ষড়যণ্ত্র করল ৷ ফলে নবী (সঃ) কে গোপনে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হল ৷ মদীনার লোকজন নবী (সঃ) কে আশ্রয়ও দিল এবং দলে দলে শত-শত লোক ইসলাম গ্রহণ করে নবীকে মদীনার বাদশাহ (শাসক) হিসাবে বরণ করে নবীর আন্দোলনকে ভীষণ শক্তিশালী করে তুলল।

   নবী মুহাম্মদ (সঃ) মদীনায় আশ্রয় ও মদীনার শাসক হওয়ার সংবাদে মক্কায় নবী বিরেধী গোষ্ঠী চিন্তিত হয়ে পড়ল ৷ মক্কার শাসক গোষ্ঠী নবীর বিরুদ্ধে মদীনায় ধরাবাহিকভাবে যুদ্ধ শুরু করল ৷ বদর, ওহুদ, খন্দক, হোদায়বিয়ার সন্ধী, খয়বর, তাবুক প্রভৃতি অসম যুদ্ধে বা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মোকাবেলা করতে নবী (সঃ) কে চরম মূল্য দিতে হল তারপরও তিনি শত্রুর বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হলেন ৷ নবী (সঃ) আত্মরক্ষার পর মক্কা শহরকে জয় করে নিলেন এবং মক্কা-মদীনায়  ইসলামকে একটি বিজয়ী আদর্শ হিসাবে প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা করার সুব্যবস্থা করলেন ৷ নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর নেতৃত্বে যে আন্দোলন সফল হল সেখানে তিনি সেই সমস্ত কাজগুলি কার্যকর করলেন যেগুলি তিনি মক্কা থেকে মদীনায় এত বছর ধরে ওয়াজ-নসীহত বা উপদেশ বিতরণ করছিলেন৷

    তিনি আল্লাহর একত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করলেন, নবী মুহাম্মদ (সঃ) এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন, নামাজ কাযেম করলেন, রোজা কায়েম করলেন, জাকাত কায়েম করলেন, হজ কায়েম করলেন, পর্দা চালু করলেন, নারী-পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন৷ চুরী, ডাকাতী, ছিনতাই, মিথ্যা, সুদ, মদ্যপান, জুয়া, গালাগালী, ঝগড়া, মারামারী, শিশুকন্যা হত্যা,রক্তপাত, মানুষ হত্যা প্রভৃতি যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার বন্ধ করলেন ৷ "তা'মুরুনা বিল মারূফি ওয়াতানহাওনা আনিল মুনকার " অর্থাৎ সব রকমের ভালো কাজ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং যত রকমের অন্যায়-অপরাধমূলক কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিলেন ৷  দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নীতি পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করলেন ৷ নারী জাতির মর্যাদা, তাদের নিরাপত্তা, তাদের সম্পত্তির অধিকার, তাদেরকে নানা প্রকারের কুপ্রথা ও অপমানজনক অবস্থা  থেকে নিষ্কৃতি ও  অন্যান্য যাবতীয় অবিচার থেকে মুক্ত করলেন ৷ সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে মূর্খামী, অজ্ঞতা, জড়তা, কুসংস্কার, বাপ-দাদাদের পরম্পরা, জাহেলিয়াতের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিলেন ৷মুনাফেকী, মুশরেকী,কপটতা, রসম-রেওয়াজ,স্বার্থপরতা,পক্ষপাতিত্ব, অসাম্য- বিভেদ ও শোষণসহ সমস্ত প্রকারের সামাজিক ব্যধি দূর করে দিলেন৷

   তিনি একাধারে ছিলেন— ন্যায়-ইনসাফ-সুবিচারের মূর্ত প্রতীক,সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা ও গণতণ্ত্রের প্রচারক, অন্যায়-জুলুম-নির্যাতনের প্রবল প্রতিবন্ধক, জ্ঞান-বিবেক-চরিত্র-সততা-ন্যায়নীতি-উদারতা-ক্ষমা-সমাজসেবা-শান্তি-মানবতা-কল্যাণ প্রভৃতি গুণের আধার ৷ তিনি একজন জননায়ক, ধর্ম প্রচারক, সমাজ সংস্কারক, সুবিচারক, যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক ও সেনাপতি, মসজিদের ইমাম, তেজস্বীবক্তা, সংগঠক, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, সন্ধীচুক্তি স্বাক্ষরকারী, আপোষহীন সংগ্রামী, শত্রুকে ক্ষমাদানকারী, বীর, বিপ্লবী, ক্রীতদাসদের উদ্ধারকর্তা, নারীদের মর্যাদা রক্ষায় সদাসতর্ক, অসহায় মানুষদের অকৃত্রিম বন্ধু প্রভৃতি অসাধারণ গুণে গুণান্বিত অতুলনীয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহান ব্যক্তি৷

    বর্তমান ভারতের মুসলমানরা নবী জীবনের আন্দোলন-সংগঠন-সমাজসংস্কার প্রভৃতি বৃহত্তর অংশ ত্যাগ করে শুধু  ritual  বা ধর্মীয় আচার ও আনুষ্ঠানিকতা গ্রহণ করেছে ৷ সেই জন্য মুসলমানরা আজ অশিক্ষিত, অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত এবং সমাজের সর্বশেষ পংক্তিতে দৃশ্যমান ৷ মুসলমানরা যদি নিজেদেরকে পুনরায় সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নত শিক্ষা, উন্নত চরিত্র, উন্নত সংগঠন,উন্নত নেতৃত্ব, উন্নত পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যকরী পদক্ষেপ ৷ প্রতিটি মুসলমান নারী হোক বা পুরুষ হোক তাকে অবশ্যই জ্ঞানী-চরিত্রবান-ঈমানদার-দায়িত্বশীল-সমাজসেবক-দেশপ্রেমিক ও সামাজিক হতে হবে ৷ নবী যেমন নারী, ক্রীতদাস ও অসহায় গরীবদের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছিলেন আমাদেরকেও দলিত-মথিত-নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিতদের প্রতি মনোযোগী ও আগ্রহী হতে হবে ৷ দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন, জনমত, ধর্ম, রাজনীতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, কম্পিউটার, ইতিহাস, প্রতিবেশী ও পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আগ্রহী হতে হবে ৷ কোরআন, হাদীসের তরজমা পাঠ, ইসলামী সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করে সমাজকে সুসংগঠিত হতে হবে ৷ ধর্মীয় মজহাব নিয়ে উপদলীয় কোন্দল, ফেরকাবাজী, বিভিন্ন জামাত বিষয়ে বাড়াবাড়ী, অযোগ্য নেতৃত্বের অনুগত হওয়া প্রভৃতি দোষগুলি ত্যাগ করতে হবে।






 width=